সরকার পাইলট প্রকল্প হিসাবে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আর সেই পাইলট প্রকল্পের তালিকায় নাম এসেছে দিনাজপুরের ১৩ উপজেলার মধ্যে চিরিরবন্দর উপজেলার।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন জমিসংক্রান্ত বিরোধের অবসান হোক
দেশে খুনাখুনির যত ঘটনা ঘটে, তার একটি বড় অংশই ঘটে জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে। যত মামলা-মোকদ্দমা হয়, তার ৮৭ শতাংশেরই পেছনে থাকে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ। ভূমি বিরোধ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করে প্রতিবছরই বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। বিরোধ নিরসনে যাদের ভূমিকা রাখার কথা, কথিত আছে, অবৈধ অর্থের বিনিময়ে সেই ভূমি অফিসই বিরোধ আরও উসকে দেয়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভূমি ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়। ২০০৯ সাল থেকে ভূমির ম্যাপ তৈরি, ভূমি অফিস, দলিল-দস্তাবেজ ডিজিটাইজেশনের কাজ চলতে থাকে; কিন্তু অবৈধ উপার্জন কমে যাওয়ার শঙ্কায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভেতর থেকেই চলে ডিজিটাইজেশনের বিরোধিতা। ২০১৩ সালে পাঁচটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও তিনটি জেলা রেকর্ডরুম ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনার কাজ শুরু হয়।
অন্যদিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমির নকশা ও খতিয়ান প্রণয়নের জন্য ঢাকার সাভার উপজেলার পাঁচটি মৌজায় এবং নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ৪৮টি মৌজায় পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রেজিস্ট্রেশন ও নামজারি কার্যক্রম সমন্বয় সাধনসংক্রান্ত একটি পাইলট প্রকল্পের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
১৭টি উপজেলায় শুরু হতে যাওয়া পাইলট প্রকল্পটি সফল হলে এই সেবা দেশব্যাপী চালু করা হবে। এতে সর্বোচ্চ আটদিনের মধ্যে নামজারি সম্ভব হবে। মন্ত্রিসভা আশা করছে, এই কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হলে ৬০-৭০ শতাংশ মামলা আপনা থেকেই কমে যাবে।
বর্তমান ব্যবস্থাপনায় ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য তিনটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমটি হচ্ছে দলিল নিবন্ধন, দ্বিতীয়টি নামজারি (মিউটেশন) এবং তৃতীয়টি রেকর্ড অব রাইটস (আরওআর); কিন্তু নামজারি এবং আরওআর—উভয় ক্ষেত্রেই অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ফলে অনেকেই এ দুটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন না। বর্তমানে এই তিনটি ধাপের কাজ দুটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিন জায়গায় সম্পন্ন হয়। দলিল রেজিস্ট্রেশন হয় আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এবং নামজারি হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা ভূমি অফিসে। দুটি কাজ পৃথকভাবে হওয়ায় কোনো অফিসই আগে থেকে জমিসংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য জানতে পারে না। এর ফলে সৃষ্টি হয় নানা অনিয়ম ও ভোগান্তির।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, এখন থেকে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ও এসিল্যান্ডের অফিসের মধ্যে পারস্পরিক তথ্য বিনিময়ের সফটওয়্যার থাকবে। বাংলাদেশের সব এসিল্যান্ড অফিসের চার কোটি ৩০ লাখ রেকর্ডস অব রাইটস (আরওআর) অনলাইনে চলে এসেছে।
সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ও এসিল্যান্ড অফিসের একজন আরেকজনের ডাটাবেইসে ঢুকতে পারবে। ফলে কেউ জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলে রেজিস্ট্রি অফিস প্রথমে সেই জমির আরওআর দেখে নিশ্চিত হবে, যিনি জমি বিক্রি করছেন তিনি ঠিক মালিক কি না।
আমরা আশা করি, নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশে সামাজিক অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের অবসান ঘটবে। পাশাপাশি ডিজিটাইজেশন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।
সারা দেশের ভূমি সেবা উঠে আসছে অনলাইনে
ভূমি সেবাকে ডিজিটাইজেশন করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। সকল ধরণের ভূমি সেবাকে নিয়ে আসা হচ্ছে অনলাইনে। এর ফলে এসিল্যান্ড, সাব-রেজিস্ট্রার, ভূমি অফিসে না গিয়েই সেবা পাওয়া যাবে। জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনা সব কাজই করা যাবে ঘরে বসে।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ জানান, দেশের সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে ভূমির সঙ্গে জড়িত। এই খাতে উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে ডিজিটাইজেশনের বিকল্প নেই। তাই মন্ত্রণালয়ের পুরো কাজ ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনা হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, ভূমি-সংক্রান্ত বিষয়াদি কেবল সরাসরি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে না, দেশের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে। তাই ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে এসিল্যান্ড, সাব-রেজিস্ট্রার ও ভূমি অফিসে মানুষের যাতায়াত কমানো। মানুষ অফিসে না গিয়ে সেবা নেবেন। ভূমির ডিজিটাইজেশনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুটি কাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, খাজনা ও নামজারি।
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন যখন খাজনা দিতে যান। এই জন্য অনলাইনে খাজনা প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেবাগ্রহীতা ইলেকট্রনিক্যাল একটি দাখিলা পাবেন। সেটাই অফিসিয়াল দাখিলা হিসেবে গণ্য হবে।
দেশের সব এসিল্যান্ড অফিসে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ (আইপি) ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। ভূমি মন্ত্রণালয়ে বসে এসিল্যান্ড অফিসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যাবে। অফিসের সবার কথাবার্তাও শোনা যাবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় মনে করছে, এটি চালু হলে দালালের দৌরাত্ম্য কমবে। কোনো রেকর্ড, নথি বের হচ্ছে কিনা দেখা যাবে। কী কী কাজ করা হয়েছে, আর কী কী বকেয়া আছে সেগুলোও দেখা যাবে।
এছাড়াও জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে দলিলের একটি কপি ভূমি মন্ত্রণালয়কে যাতে দেওয়া হয়, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা (জমির মালিক) রেজিস্ট্রেশনের আবেদনের সঙ্গে অফিসে তিন কপি দলিল জমা দেবেন।
এর মধ্যে এক কপি সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে থাকবে, আরেক কপি জমির মালিককে দেওয়া হবে, আরেক কপি ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসনের প্রতিনিধি এসিল্যান্ডের কাছে পাঠানো হবে। তিনি কপি পাওয়ার পর জমির নামজারির কাজ শুরু করবেন।